কৃষি অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিতে পারে হাওরের উন্নয়ন

বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পেছনে হাওরবাসীর অনন্য অবদান রয়েছে। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ৩০-৩৫ শতাংশ মাছের সরবরাহ আসে এই হাওরের পাললিক জলাশয় থেকে। হাওরের মানুষ তাদের জীবনাচরণে ও মননে অতি প্রাকৃতিক। হাওরের পরিবেশও প্রাকৃতিক। হাওরাঞ্চলে এখনো অনেক জাতের দেশীয় ধানের চাষাবাদ টিকে আছে। দেশীয় জাতের বিলুপ্তপ্রায় মাছ এখনো হাওরাঞ্চলে পাওয়া যায়। হাওরজুড়ে পাখির অভয়ারণ্য। বিস্তীর্ণ জলাভূমি, হিজল-করচের বাগ আর নীরব প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে হাওর অঞ্চলে পরিযায়ী পাখির সমাগম হয় বেশি। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হাওর এতদিন ছিল দৃষ্টির আড়ালে। তবে আশার খবর হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাওরের সম্ভাবনা নিয়ে গ্রহণ করা হয় হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা জানি, শেখ হাসিনার আগ্রহে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এলাকায় এখন ফসল ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় হাওরবাসীর অকাল বন্যায় ফসলহানির অনিশ্চয়তাও ঘোচানো সম্ভব হবে। হাওর নিয়ে এখন একটি আশাবাদের জায়গা তৈরি হয়েছে। হাওরবাসীর প্রত্যাশা, সমন্বিত ও পরিকল্পিত উপায়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ১০ বছরে পাল্টে যাবে হাওরের অর্থনৈতিক চেহারা। সমুদ্র নয়, সমুদ্রের মতোই অথই দরিয়াহাওর এলাকাকে ভাটি এলাকাও বলা হয়। হাওর একটি বিশাল চ্যাপ্টা বেসিন, বাটির মতো। দেশের অন্য অঞ্চল হতে নিচু, সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়। উজান হতে বর্ষায় নেমে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি এ বেসিনে জমে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। নির্মল বায়ু, অববাহিকার অথই জলরাশি আর জলসহিষ্ণু গাছগাছালি কেবল হাওরেই দেখা যায়। সমুদ্র নয়, কিন্তু সমুদ্রের মতোই আদিগন্ত জলরাশির নামই হাওর। হাওর স্থায়ী জলাশয় নয়, বর্ষায় যেখানে পানি আর পানি, শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল চোখ জুড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত আর ঘাসের চট্টন। ধান, মাছ, গবাদি পশু, পাখি, জলজ প্রাণী, জীববৈচিত্র্য, পর্যটন, কালোমাটি, জ্বালানি কাঠ, বালি, পাথর, মুক্তাসহ আরো অনেক অজানা সম্পদ লুকিয়ে আছে হাওরের মাটির নিচে। হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত এলাকাজুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে লুকায়িত সম্ভাবনাগুলোকে জাগিয়ে তুলে কাজে লাগতে পারলে সত্যিই বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে।

প্রকৃতির সাথে লড়াই 

হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের অতি প্রাকৃতিক জোন; যদিও অতি প্রাকৃতিক জোন হিসেবে আজো হাওরকে স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন করা হয়নি। শত বছরের হাওর বাংলার কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই হাওরবাসী বংশপরম্পরায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকে। অসময়ে বন্যা, অতিখরা, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কালবোশেখি ঝড় আর ৬ মাস অথই পানির বিনাশী আফালের (ঢেউ) তাণ্ডবলীলার সাথে হাওরবাসীর যুদ্ধ যেন নিয়তির লিখন। বছরের ৬ মাস পানিতে ভাসমান আর ৬ মাস শুকনা থাকার প্রাকৃতিক নিয়মের ছকে বাঁধা হাওরবাসীর জীবনচক্র। প্রকৃতির বৈরিতায় একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রাস করে নিয়ে যায় হাওরের সোনার ফসল। কখনো পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টিতে ফসল হারায় হাওরের মানুষ। কখনোবা কালবোশেখি আর শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসব প্রাকৃতিক বৈরিতার সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে বজ্রপাত আতঙ্ক। প্রকৃতির মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করতে হয় হাওরবাসীকে।

হাওরের প্রাণ মাছ আর ধান

হাওরকে বলা হয় মাছের খনি। দেশের আহরিত মৎস্যের শতকরা ২৫ ভাগ মৎস্য হাওরাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে। দেশীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অনেক মাছ এখনো হাওরে টিকে আছে। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, হাওর হলো মাদার ফিশারি। এখানে মিঠাপানির মাছ আছে ১৫০ প্রজাতির। ‘মাছ আর ধান হাওরের প্রাণ’-হাওরাঞ্চলের মানুষ একসময় গর্ব করে বলত। বর্ষার ছয় মাস হাওরের অথই পানিতে বেড়ে উঠে দেশীয় প্রজাতির মাছ। আবার পানি যখন শুকিয়ে যায় তখন বাহারি প্রজাতির দেশীয় মাছ সব গিয়ে জমা হয় হাওরের নিম্নাঞ্চল জলমহালে। হাওরাঞ্চলের জলরাশিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জাতের মাছ, যেমন কই, সরপুঁটি, পুঁটি, তিতপুঁটি, কাতলা, মাগুর, খৈলসা, বাঁশপাতা, আইড়, টেংরা, বাইম, চিতল, ভেদা, পাবদা, গজার, শোল, মহাশোল, চাপিলা, কাকিলা, বোয়াল, মৃগেল, রুই, কালবাউস প্রভৃতি। গত প্রায় এক দশকে বাঘাড়, তিলা শোল, ঘাউড়া, বাচা, ঘোড়া মুইখ্যা, পাঙাশ, রিটা, মহাশোল, বামোশ, রানি, গজার, কাশ খাউড়া, কালাবাটা, ঘইন্যা, শাল বাইম, গুইজ্জা, চিতল, কানি পাবদা, গুজি আইড়, হলুদ-সোনালি দেহের নয়ন জুড়ানো রানি মাছসহ প্রায় ৬২ প্রজাতি মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। 

পর্যটন সম্ভাবনা : উড়ালপঙ্খির দেশ

হাওর প্রকৃতির অপরূপ লীলানিকেতন। হাওরের প্রতিটা ক্ষণ উপভোগ্য। বৈশাখের ফসল তোলার মৌসুমে প্রকৃতির নতুন রূপ আর হাওরাঞ্চলের মানুষদের জীবন-জীবিকার ব্যস্ততা প্রকৃতিবান্ধব সারল্যে ভরপুর। শীতে কুয়াচ্ছন্ন হাওরের অতিথি পাখিদের অবাদ বিচরণ। বর্ষায় হাওরের ছোট ছোট দ্বীপের মতোন বাড়িঘর। শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের মায়াবতী দৃশ্য কিংবা বিকেলের স্নিগ্ধতায় দূরের পাহাড়ের হূদয়কাড়া সৌন্দর্য সবকিছুকে বিধাতা যেন অঢেল অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন। হাওরের পানিতে চাঁদের আলোর মায়াভরা স্মৃতি যে কারো হূদয় কাড়বে। হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে প্রতিদিন ভিড় করেন ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থী এবং পর্যটক। বিশাল এই হাওরকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটনশিল্প সমৃদ্ধ হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগমে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের এ হাওরগুলো দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।

করচের তেলে বায়োডিজেল

জনশ্রুতি আছে-‘হিজল-করচ-আড়াং বন, হাওরের মূলধন।’ এশিয়া উপমহাদেশ তথা ভারত এ উদ্ভিদটির উৎপত্তিস্থল বলে জানা যায়। করচ ঘন ডালপালাবিশিষ্ট বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ। করচের তেল বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে বিস্তর গবেষণা চলছে। সুনামগঞ্জ জেলার ১৩৩টি ছোট-বড় হাওরে কমবেশি প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া হিজল-করচের গাছ রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় হিজল-করচের বাগ। এপ্রিলে করচের ফুল ফোটে। অযত্ন, অবহেলার কারণে হিজল-করচ বাগ হারিয়ে যাচ্ছে। নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে পরিকল্পিতভাবে রোপণ করলে হাওরে হিজলগাছ বনায়ন তৈরিতে সহায়ক হবে।  দেশের জ্বালানি তেলের এ চরম সংকটকালে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে করচগাছ। করচের তেল বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব বলে জানা গেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্নাবান্না, পাম্প মেশিন চালানো, পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহূত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে এর তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহূত হয়। করচের খইল পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া খইল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং নেমাটোডের বিরুদ্ধে কাজ করে। বায়ো-গ্যাস উৎপাদনের জন্য খইল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত। এক হেক্টর জমির করচগাছ বছরে ৩০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল  থেকে শোষণ করে। অন্যদিকে বায়ো-ডিজেল হিসেবে করচের তেল জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় ৭৫ ভাগ কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে। তাই কার্বন ক্রেডিটের বিবেচনায় করচের গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা একটা নাইট্রোজেন ফিক্সিং উদ্ভিদ। এর শিকড়ে বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন জমা করে রাখতে পারে যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এটা মাটির ১০ মিটার গভীর থেকে পানি এবং পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করতে পারে এবং প্রচণ্ড খরা সহ্য করতে পারে। 

আগামী দিনের খাদ্যভান্ডার

সারা দেশের মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়ে হাওরের কৃষকরা বাংলাদেশের কৃষি-অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। দেশের এক-পঞ্চমাংশ ধান হাওরে উৎপাদিত হচ্ছে। আজ ও আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে হাওর এলাকা। বছরে একটিমাত্র ফসল হলেও বছরে প্রায় তিন লাখ টন ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায় হাওরবাসী। দুঃখ কিংবা গর্ব যাই হোক, বলা হয়ে থাকে- একফসলি ধান; হাওরবাসীর প্রাণ। সত্যিই বছরে একটিমাত্র ফসল হলেও বিরল বিচিত্র দেশি জাতের অনেক ধান এখনো এ হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। এককালে হাওরে জন্মাত টেপী, বোরো, রাতা, শাইল, লাখাই, মুরালী, চেংড়ি, সমুদ্রফেনা, হাসিকলমি, কাশিয়াবিন্ন, দুধরাকি, দুধসাগর, লাটলি, মারতি, তুলসীমালা, আখনিশাইল, গাছমালা, খৈয়াবোরো, রাতাশাইল, দেউড়ি, কন্যাশাইল, বিচিবোরো, লোলাটেপী, পশুশাইল, হাঁসের ডিম, গুয়ারশাইল, বেতী, ময়নাশাইল, গদালাকি, বিরঅইন, খিলই, ছিরমইন, আগুনী, গুলটিহি, ল্যাঠা, জাগলীবোরোর মতো অবিস্মরণীয় সব গভীর পানির ধান জাত। এখন ইরি, বোরো, টেপি, রাতা, ময়না, টিয়া, তেজ, আফতাব ধান বেশি চাষাবাদ হয়। কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওর অঞ্চলের জলাবদ্ধ এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব।

 

বিকল্প জ্বালানি কালোমাটি

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলায় বিল, হাওর, বাঁওড় অঞ্চলে এক ধরনের কালোমাটি পাওয়া যায়, যা অত্র এলাকার জ্বালানির অন্যতম উৎস। এই মাটিতে পচা পাতা-গুল্ম, কয়লাখণ্ড, গাছের ডাল, কাঠের টুকরা ইত্যাদি উপাদান মিশে থাকে। এ কালোমাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলে। কালোমাটির দাহ্য ক্ষমতা বেশি দ্রুত রান্না করা যায়। কালোমাটি দিয়ে রান্না করার জন্য লোহার রড দিয়ে ছাঁকনির মতো তৈরি একটি বিশেষ ধরনের চুলা ব্যবহার করা হয়। রান্না শেষে ছাইগুলো ছাঁকনি নিচে পড়ে থাকে। এতে ঝামেলাও অনেক কম হয়। এক মণ কালোমাটি দিয়ে একটি বড় পরিবারের এক সপ্তাহের রান্নাবান্না করা যায়। তাই কালোমাটি আহরণ করে রোদে শুকিয়ে সারা বছরের জ্বালানি হিসেবে নিজেরা ব্যবহার করেন এবং বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন হাওরবাসীরা। কালোমাটি দিয়ে তৈরি জ্বালানি ব্যবহার করে দরিদ্র ও শ্রমজীবী নারীরা পরিবারের জ্বালানি খরচ সাশ্রয় করছেন।

হাওরের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রস্তাবনা 

বাংলাদেশে সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাওরাঞ্চলের অনবদ্য অবদান ও ভূমিকার জন্য আগামী দিনের খাদ্য ও মৎস্য ভান্ডার হিসেবে হাওরাঞ্চলকে স্বীকৃতি দিন। বিশালাকার এই প্রাকৃতিক পললভূমির জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি হলেও গুরুত্ব অনুধাবনের অবহেলায় আজো একটি ‘হাওরবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠিত হয়নি। দেশের সকল জেলায় জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুনামগঞ্জে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। হাওরের কেন্দ্র সুনামগঞ্জে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ‘হাওর বিশ্ববিদ্যালয়’ হতে পারে। হাওর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক এলাকা। কোনো অবস্থাতেই এই প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। পাহাড়ের পলিবাহিত পানিকে হাওরের শত্রু না ভেবে অকাল বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষায় উৎপাদন সময় কমিয়ে বা এগিয়ে আনার কথা ভাবতে হবে।  কম সময়ে উন্নত জাতের অধিক ফলনশীল ধান চাষ করা দরকার।  তারও আগে দরকার হাওর এলাকাকে একফসলি নির্ভরতা থেকে বের করে নিয়ে আসা। জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে আমন মৌসুমের জন্য আরো পাঁচটি উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের বীজ আনা হয়েছে, যা মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ দিনে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। এ ধরনের ধানকে হাওরের উপযোগী করতে গবেষণা চালাতে হবে। আমাদের কৃষি ও জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী এক জাতের ধান চাষের পরামর্শ দিয়েছেন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। এই হাওরাঞ্চলের সফল ১০ বছর নিরাপদে ঘরে তুলতে পারলে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ থেকে উন্নত ও স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার জেলাকে হাওর ইকোনমিক জোন ঘোষণা করে সেখানে হাওরের উপযোগী শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। চীনের দুঃখ হোয়াংহু আর হাওরবাসীর দুঃখ বাঁধ। বাঁধগুলোকে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের নেতৃত্বে স্থায়ীভাবে নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে।  মেঘালয় থেকে আগত ঢলের পানি যে স্থানটিতে প্রথমে এসে পড়ে সেখানটায় মাটি খনন করে জলাধার বানাতে হবে। তাহলে প্রথমেই পানির ঢল এসে সেখানে জমা হবে এবং পানির প্রবাহ চাপ কমবে। নদীগুলো খনন হলে পানি নদীতে প্রবাহিত হতে হতে ফসল ঘরে উঠে আসবে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, ডোবা, খন্তাগুলো খনন এবং অকাল বন্যারোধী বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে নির্মাণ করলে হাওরের ৮০% সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। এই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সুফল পাবে হাওরের জনগণসহ সারাদেশবাসী। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের জনবল বাড়িয়ে মনিটরিং, ডাটা কালেকশন, পরিদর্শন, প্রচারণা, প্রকাশনা, গবেষণাসহ কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করা দরকার।

হাওর উন্নয়ন বোর্ড যা যা করতে পারে

হাওরাঞ্চলের সাংবাদিকদের নিয়ে উন্নয়ন সাংবাদিতাবিষয়ক ওয়ার্কশপের আয়োজন করা। হাওরাঞ্চলের লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে হাওরের সৌন্দর্য ও সম্ভাবনাকে উপজীব্য করে লেখালেখির জন্য পরামর্শ সভা, কর্মশালা অথবা ২/৩ দিনের ওয়ার্কশপ করা। হাওরবিষয়ক রিপোর্টিং, প্রকাশনা ও লেখালেখিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বছর সাংবাদিক ও লেখক সন্মাননা বা হাওর ক্রিয়েটিভ অ্যাকটিভিটিজ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা। ঢাকার জাতীয় দৈনিক, জনপ্রিয় অনলাইন এবং চ্যানেলের সাংবাদিকদের নিয়ে হাওর ভ্রমণের আয়োজন করা। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড-এর ওয়েবসাইটটি নিয়মিত বাংলায় আপডেট করা। হাওরের সার্বিক উন্নয়ন, সমস্যা, কার্যক্রম, কর্মসূচি, উদ্যোগ, আয়োজন সর্বোপরি হাওরাঞ্চলের সার্বিক তথ্য ও সংবাদ নিয়ে একটি ‘মাসিক হাওর বার্তা’ প্রকাশনা করা।  বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড-এর ফেসবুক পেজ চালু করা এবং এতে সব ধরনের সংবাদ লেখালেখি, ছবি, ভিডিওচিত্র ইত্যাদি প্রচার করা। হাওরের উন্নয়নে বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়মিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করা। স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষক, কৃষক, ব্যবসায়ী, খামারি, উদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশাদার মানুষের সাথে উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে মতবিনিময় করা। হাওরকে প্রাকৃতিক মৎস্যভান্ডার ঘোষণা করা। বর্ষায় হাওরের পানিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা অবমুক্ত করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে ঘের করে এই পোনা বড় হওয়া পর্যন্ত্ত অপেক্ষা করে পরে তা মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা। মুক্ত জলাশয়ে ঘের পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং ভাসমান সবজি চাষের কথা ভাবা যেতে পারে। হাওরের নদী, খাল ও ডোবাগুলো খনন হলে প্রাকৃতিভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছ বাড়বে। হাওর ট্যুরিজমকে জনপ্রিয়করণে ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশনা দরকার। অনলাইনভিত্তিক প্রচারণার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব এবং ওয়েবসাইট ভূমিকা রাখবে। টুর অপারেটরদের সাথে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পর্যটনকেন্দ্র গড়ে না ওঠায় হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পড়তে হয় নানামুখী বিড়ম্বনায়। হাওরের পর্যটন খাতকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে দুই ঋতুতেই বিরাট অর্থকরী ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে হাওরাঞ্চল। খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, কিশোরগঞ্জ, নিকলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, তাহেরপুর, মধ্যনগর, ভোলাগঞ্জ, টেকেরহাট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালগঞ্জ এসব জায়গায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এই ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত হলে হাওরাঞ্চলের পর্যটন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। পর্যটন খাতে অনেক আয় হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। বর্ষাকালের আফাল বা ঢেউয়ের তাণ্ডব থেকে বাড়িঘর রক্ষার জন্য করচ-হিজলের ব্যারিকেড তৈরি করতে হবে। উন্মুক্ত উঁচু স্থানে হিজল, করচ ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে জঙ্গল তৈরি করে জ্বালানি কাঠের চাহিদা মিটানো যেতে পারে। জঙ্গলে বর্ষায় মাছের উত্তম জায়গা হবে। পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা যেতে পারে। হাওরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা হওয়ার ফলে যোগাযোগ উন্নত হলেও হাওরের পানি, পলি ও মৎস্য অবাধে বিচরণ করতে পারছে না। এজন্য রাস্তায় ঘন ঘন কালভার্ট বসানো দরকার। এতে পলিবাহিত মাটির উর্বরতা সবদিকে ছড়াবে। মাছের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়বে। সহজ শর্তে বা ঋণ দিয়ে সৌর বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োজিত করতে হবে। তাদের হাওরের পরিবেশ উপযোগী প্রশিক্ষণ, মোটিভেশন এবং মানসিকতায় তৈরি করতে হবে। দুর্গম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মীদের জন্য ভালো মানের থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। হাওরাঞ্চলের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের জন্য বছরে ১টি বা ২টি বিশেষ উৎসাহ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্ষায় ভাসমান চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। বর্ষাকালের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব  মেশিনচালিত নৌবাহন থাকা আবশ্যক। কারণ যাতায়াত ঝুঁকি ও জটিলতার জন্য বর্ষাকালে শিক্ষার্থীরা স্কুলে কম যায়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখর করতে হলে তাদের মেয়াদি ঋণ ও আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

হাওরাঞ্চলের কিশোরী ও নারীদের কর্মমুখী করার জন্য হাঁস, মুরগি, কবুতরসহ গৃহপালিত পশু পালন, দুগ্ধ খামার, মোষের বাথান, ভেড়া ও ব্ল্যাকবেঙ্গল পালন, সবজি উৎপাদন, মুড়ি, চিড়া, খই তৈরি ও প্যাকেটজাতকরণ, শুঁটকি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্ত্ত ও কুটিরশিল্প খাতে নারীদের নিয়োজিত করা যেতে পারে। শুকনা সময়ে পতিত চট্টন এলাকাকে কী করে উৎপাদনশীল হিসেবে তৈরি করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে পুরো ৬ মাসে উপযোগী সবজি ও শস্য উৎপাদনের কথা ভাবা যেতে পারে। হাওরের মাটিতে ফলন উপযোগী সরিষা, মাষকলাই, মসুর, ভুট্টা, গম, সূর্যমুখী ফুল, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। বর্ষায় আখ চাষ, ভাসমান সবজি চাষ করা যায় কি না ভাবতে হবে।  মোটকথা প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়ন উদ্যোগ নিলে হাওরের প্রকৃত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।